ঢাকা , বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ , ৪ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​স্বাধীন বাংলা বেতারকে একটি সেক্টরের মর্যাদা দেয়া হোক : নমিতা ঘোষ

আপলোড সময় : ১৬-১২-২০২৪ ০২:৫০:০৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ১৬-১২-২০২৪ ০২:৫০:০৯ অপরাহ্ন
​স্বাধীন বাংলা বেতারকে একটি সেক্টরের মর্যাদা দেয়া হোক : নমিতা ঘোষ ছবি কৃতজ্ঞতা : নমিতা ঘোষ
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা নমিতা ঘোষ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, ২৬ মার্চ ২০২১ সালের স্বাধীনতা দিবসে পরলোকগমন করেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। জর্জকোর্টে গার্ড অব অনার জানিয়ে রাজধানীর পোস্তগোলা শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনেই প্রতিরোধের দেয়াল গড়তে ঘর ছাড়েন এই মহৎপ্রাণ কন্ঠযোদ্ধা। ২০১৯ সালে স্বপ্নটোকাই নামের একটি সংস্কৃতিবিষয়ক ফেসবুক পেইজের অ্যাডমিন নিয়াজ মোরশেদ (বর্তমানে বাংলা স্কুপের মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট) একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা নমিতা ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ৫৩তম বিজয় দিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই সাক্ষাৎকারটি হুবুহু তুলে ধরা হলো। 

সুমধুর শব্দ স্বাধীনতা। তবে শব্দটির অন্তরালে থাকা প্রতিবাদ, ত্যাগ, স্বপ্নের প্রকাশ ভাষায় ব্যক্ত করা সত্যিই অসম্ভব।প্রতিটি বিজয়ের নেপথ্যে থাকে বিসর্জনের গৌরবময় ইতিহাস। একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী অল্পকিছু মানুষ ছাড়া এই ব-দ্বীপের প্রত্যেকেই অংশগ্রহণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি লড়াই করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। অন্যরা মনস্তাত্বিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে শামিল ছিলেন এবং সংখ্যায় এরাই ছিলেন বেশি। এই অংশের পুরোভাগে ছিল বাংলার শিল্পীসমাজ।
শব্দের শক্তিকে কণ্ঠ দিয়ে প্রয়োগ করে স্বাধীনতার পথকে করেছেন সহজ। তাঁদের কণ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের করেছে অনুপ্রাণিত, প্রত্যয়ী ও উজ্জীবিত। এই কণ্ঠযোদ্ধারা স্বাধীনতার এতো বছর পরেও থেকে গেছেন অন্তরালে। তাঁদের স্মৃতিচারণা 'একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা' শিরোনামে প্রকাশ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছড়িয়ে দেবার আন্তরিক প্রয়াস মাত্র।
নমিতা ঘোষ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম নারী শিল্পী। মুক্তিবার্তা নম্বর ৪৮২। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নং- ম২৬৫৫৩। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করে গেছেন। অনুপ্রাণিত করেছেন মুক্তিকামী বাঙালিকে। সংগঠিত করেছিলেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষকে। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় গণসংগীত পরিবেশন করতেন, অর্থ সংগ্রহ করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। সেই অর্থ জমা হতো মুজিবনগর সরকারের তহবিলে।নমিতা ঘোষ কিশোরী বয়সে মুক্তিযুদ্ধের আগুনে নিজেকে সেঁকেছেন। ষাটোর্ধ্ব নমিতা ঘোষ বললেন হিরণ্ময় সেই দিনগুলির কথা।
নিয়াজ মোরশেদ : মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার অনুভূতি বলুন।
নমিতা ঘোষ: প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। এ এক অসহনীয় বেদনা। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের মধ্যে আমিও একজন। বাবা-মা ও ভাইবোনের সাথে ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল আগরতলা রাজবাড়ী ক্যাম্পের শরণার্থী হই। সেখানে প্রধান কংগ্রেস নেতা প্রিয়দাশ চক্রবর্তী ক্যাম্পে এসে আমার শিল্পী পরিচয় পেয়ে নরসিংগর পলিটেকনিকাল হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আলী আহসান, সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী, মুক্তিযোদ্ধা খসরুসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরিবার। এদের  প্রত্যেকেই বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাথে। তখন বুঝতে পারিনি। তবে এখন মনে হয়, সহনশীলতা নিয়ে জয়ের অপেক্ষাই ছিল অনুভূতির বিরাট অংশ জুড়ে।
নিয়াজ মোরশেদ : মুক্তিযুদ্ধে আপনার ভূমিকা কী ছিল? 
নমিতা ঘোষ: ১৯৬৯ সালে গঠিত হওয়া বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হই। এ সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মা বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা। অন্য কণ্ঠশিল্পীদের সঙ্গে মিলে মুক্তিযোদ্ধােদর ক্যাম্পে-ক্যাম্পে গণসংগীত গেয়ে অনুপ্রেরণা জোগাতাম। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে অর্থ, জামা-কাপড়, খাবার ইত্যাদি সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পাঠাতাম। একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের জন্য আমার, চিত্রনায়িকা কবরী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছিল। সেখানে আমি কিছু কথা ও আমাদের জাতীয় সংগীত উপস্থাপন করি। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি সাত-আট মাস ধরে ভারতের বিভিন্ন সিনেমা হলে প্রদর্শন করা হয়েছিল। এ থেকে উপার্জিত অর্থ চলে যেত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায়। চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৯ মে প্রথম নারী শিল্পী হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কণ্ঠ দিই। পরে আরো নারী শিল্পী আমাদের সাথে যুক্ত হয়। সাবেক কেবিনেট সেক্রেটারি তৌফিক ইমাম সাহেবের সহযোগিতায় আগরতলা থেকে মে মাসে মা ও আমাকে বিমানে করে কলকাতা পাঠানো হয়। সেখানে সংহতি শ্রী মহিলা হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয়। পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক আমিনুল হক বাদশা ভাই আমাকে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেই থেকে দেশের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাই কণ্ঠ দিয়ে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা বলতে গেলে প্রথমেই সংগীতশিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, স্বপ্না রায় তাদের কথা আসতে হবে। আমরা চারজন আগরতলা থেকে সরাসরি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শেষদিন পর্যন্ত কাজ করেছি। আমরা সেখানে যে গানগুলো করতাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, জয় বাংলা বাংলার জয়, এ ঘর দুর্গ, বিজয় নিশান উড়ছে ওই, নোঙ্গর তোল তোল, সোনা সোনা সোনা, একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে, পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে সহ বেশকিছু কালজয়ী গান। চিত্রপরিচালক দিলীপ সোমের ‌'বিক্ষুব্ধ বাংলা' গীতিআলেখ্য নিয়ে আমরা বোম্বে, দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে পরিবেশন করেছি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ভারতের অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান, সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখার্জি, সলীল চৌধুরি, সবিতা চৌধুরি, সলীল ঘোষসহ আরো অনেকে। বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী নিবেদিত 'বিক্ষুব্ধ বাংলা' ও বিচিত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি আমি আমার যুদ্ধের কর্মসূচি শেষ করি।
নিয়াজ মোরশেদ : কণ্ঠযোদ্ধা কী? 
নমিতা ঘোষ: মুক্তিযোদ্ধারা সেক্টরে সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। আর আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার ও দেশ-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করেছি। আমাদের কণ্ঠ শুনে মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হতেন। আমি দেশের জন্য কাজ করেছি, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি কণ্ঠ দিয়ে। তাই বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। 
নিয়াজ মোরশেদ : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্পর্কে বলুন।
নমিতা ঘোষ: কলকাতা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দোতলায় যে বাড়িটি ছিল সেটাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এক সময় মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ সেখানে থাকতেন। সেই ছোট বাড়িটির চারদিকের দেয়ালে বিছানার চাদর ও কম্বল ঝুলিয়ে আর দরজা-জানালার ছিদ্রগুলো বন্ধ করে বেতার স্টুডিও বানানো হয়েছিল। খুব গোপণ বিষয় ছিল। তিন-চারজন লোক ছাড়া অন্য কেউ জানত না। সেখান থেকেই অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো। প্রথমে কোরান তেলাওয়াত, বাংলা খবর, ইংরেজি খবর, চরমপত্র ও তাহের সুলতানের জাগরণী দেশাত্ববোধক গান। সেই গানগুলি আমরা গাইতাম। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা সেই গান শুনে একটু একটু করে এগিয়ে যেতেন। সেই গান মুক্তিযোদ্ধা ভায়েদের শক্তি ছিল। পূর্ব বাংলার লোকেরা ছোট্ট রেডিও কানে দিয়ে খবর শুনতেন। গান শুনে সান্তনা পেতেন- দেশ স্বাধীন হবেই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যেভাবে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীরা কাজ করেছি তাতে করে স্বাধীন বাংলা বেতারকে মুক্তিযুদ্ধের একটি সেক্টরের মর্যাদাদানের দাবি রাখতে পারি।
নিয়াজ মোরশেদ : স্বাধীনতার এতো বছর পরে এসে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সমীকরণ মিলেছে কি?
নমিতা ঘোষ: বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৯ বছর। এর মধ্যে তিনটি সরকারের শাসনামল গিয়েছে। তারা যদি দেশগঠনে আমাদের স্বতস্ফূর্ত সমর্থন দিতেন তাহলে হয়ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের অংশগ্রহণ আরো সক্রিয় হতো। যাই হোক, স্বাধীনতার এতো বছর পরে হলেও স্বাধীনতার সপক্ষের বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। 
তবে এখানে একটু কথা থাকে যে, যুদ্ধ তো বার বার হয় না. একবারই হয়। আবার নাও হতে পারে। আমরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি, দেশের জন্য কাজ করতে পেরেছি- এটাই আমাদের গর্ব, আমাদের বড় প্রাপ্তি। দেশ এবং দেশের মানুষ ভালো থাকলেই শান্তি অনুভব করি। নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে বলতে চাই- তোমাদের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছি, দেশকে সজ্জিত করার দায়িত্ব তোমাদের।

বাংলা স্কুপ/ডেস্ক/এসকে

 


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ